ভাইয়া আমি আবরার ফাহাদ!
হঠাৎ চমকে উঠেছি কারো হাতের স্পর্শে। পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখি সুদর্শন এক যুবক। অন্ধকার কক্ষ মুহুর্তেই আলোকিত হয়ে গেল তার আগমনে। এই যেন জান্নাতি যুবকের আগমন ঘটেছে মাটির পৃথিবীতে। তার চেহারায় নুর চমকাচ্ছে। হাসিতে যেন মুক্তা ঝরছে। চাহনিতে ভালবাসা যেন উপছে পড়ছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ভাই আপনি কে?
ঐ সুন্দর যুবকটি মুচকি হেসে নম্রতার সাথে উত্তর দিল আমি আবরার ফাহাদ।আমি চমকে উঠে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কোন আবরার ফাহাদ? যুবকটি একটু অবাক হয়ে বললেন দু’দিনেই ভুলে গেলেন? আমি সেই আবরার ফাহাদ।
আমি সেই বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ যার জন্য আপনিও কেঁদেছেন। আমি আপনার রক্ত সম্পর্কের কোন আত্মীয় স্বজন না হলেও আমার জন্য আপনার চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়েছে।
ভাইয়া আপনিই বলেন, আমি কি কোন অন্যায় করেছিলাম? আমি তো আমার স্বাধীন সার্বভৌম সোনার বাংলার পক্ষ হয়ে ভারতীয় চুক্তির সমালোচনা করেছিলাম। সমালোচনা করার অধিকার তো সংবিধান দিয়েছে।
তাহলে কেন ঐ হায়েনারা আমাকে মেরে রক্তা করেছেন? কেন তারা আমাকে সোনার বাংলা থেকে চিরতরে তাড়িয়েছে? সেই প্রশ্ন কি কেউ করছে না? আজও কেন সেই হিংস্র জানোয়ার গুলো বুক ফুলিয়ে হাঁটে।
এই যে দেখেন তারা আমাকে কতটা আঘাত করেছে। যখন তারা আমাকে ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে আঘাত করেছিল তখন আমি তাদের বলেছিলাম আমি শিবির করিনা কিন্তু তারা আমার কথা বিশ্বাস করেনি। এক পর্যায়ে আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি।
ধীরে ধীরে শক্তি ক্ষয় হতে থাকে। তাদের কাছে একটা অনুরোধ করেছিলাম যেন আমাকে প্রাণে না মারে।
বললাম ভাই, আমি মা বাবাকে কথা দিয়েছি আমি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশ ও জাতির সেবা করব কিন্তু তারা আমার কোন কথা শুনেনি। এলোপাতারি মারতে মারতে আমি বেহুশ হয়ে পড়ি। তখন আল্লাহকে স্মরণ করেছিলাম বার বার।
তারা তাও সহ্য করতে পারেনি। সজোরে মারল লাথি আর স্ট্যাম্পের বাড়ি। তখন মা ও বাবার চোহারাটা চোখের সামনে ভাসছিল। মা বাবাকে খুব বলতে ইচ্ছা হয়েছিল আমি তোমাদের আশা পূরণ করতে পারিনি। তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দিও। খুব যন্ত্রণা হচ্ছিলা। এই বুঝি প্রাণ বায়ু উড়ে যাবে। জিব্বাহ নাড়িয়ে কালেমা পড়তে পড়তে কি হয়ে গেল জানা নেই।
ভাই একটা অনুরোধ রাখবেন? আমার এই রক্ত মাখা জামাটা মাকে দিবেন। মাকে বলবেন আবরার ফাহাদ সুখেই আছে কিন্তু সবার জন্য তার প্রাণটা ছটপট করে বার বার। তোমার ছেলে তোমাদের আশা পূরণ করতে পারেনি বলে ক্ষমা চেয়েছে।
জানেন ভাইয়া, আমি একদিন ফোন না করলে মা কান্না করত। মাসে মাসে বাড়ি না গেলে মার শান্তি হতনা। সেই দিন মা আমাকে কতই না আদর করল। সেদিন বলল তুই পড়ালেখায় মন দে। সাথে সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বি। সেই বার তাবলীগে গিয়ে মায়ের জন্য একটি তাসবিহ এনেছিলাম। এটাই ছিল জীবনে মাকে কিছু দেওয়া।
বাড়িতে গেলে মা তো অস্থির হয়ে যেত কি রান্না করবে। কত রকমের পিঠা মা তৈরি করে খাওয়াতো তা ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ছে। ছোট বেলায় একবার আমার জ্বর হয়েছিল। মা প্রায় পাঁচ দিন নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল।
গত রমজানের ঈদের সময় মাকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম খালার বাসায়। খালু বলল, আবরার ফাহাদ অনেক বড় হয়েছে। এখনো কিন্তু মায়ের আচল ছাড়েনি। মা হেসে বলেছিল আমার এই আচল আমার ফাহাদের আশ্রয়স্থল। কিন্তু আজ তোমার আচল তোমার ফাহাদকে ধরে রাখতে পারেনি।
ভাইয়া আমার বাবাকে, একটি সালাম দিবেন। বাবা খুব ভেঙ্গে পড়েছে আমাকে হারিয়ে। সেই দিন বাবা এক বন্ধুকে ফোন করে বলছে, আমার ফাহাদ এখন বুয়েটে পড়ে। বুয়েটে পড়ার সুযোগ পাওয়ার পর বাবার মত খুশি কেউ হয়নি। আমাকে জড়িয়ে ধরে সেদিন বাবা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
বাবাকে বলবেন, আমার কক্ষ থেকে আমার বই পত্র গুলো নিয়ে আসতে। বই গুলো আমার সবুজ আলনায় সাজিয়ে রাখতে বলবেন। আর দেশের মানুষদের বলবেন, ফাহাদ মরেনি সে বেঁচে থাকবে যুগ থেকে যুগান্তরে। দেশপ্রমে নিয়ে আমি চোখের আড়াল হয়েছি বটে আগামীর প্রজন্মকে হায়েনাদের বিরুদ্ধে আমিই জাগিয়ে তুলব।
ঐ সুদর্শন যুবকের কথা শেষ হতেই আমি বললাম ভাই এসো একটু আলিঙ্গন করি।জীবিত অবস্থায় দেখা হয়নি অন্তত এখন একটু জড়িয়ে ধরি পরম স্নেহে। জড়িয়ে ধরতেই ঘুম ভেঙ্গে যায়।
বুঝতে পারলাম সেটা স্বপ্ন ছিল কিন্তু তখনো আমার চোখের পানি ঝরছে।