জাতীয় কবি পরিষদ (জাকপ) কর্তৃক আয়োজিত সাপ্তাহিক নির্বাচিত কবিতা সপ্তাহ নং ১০৪ এর ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। বিচারকদের দক্ষ যাচাই বাছাই শেষে ২১ জন কে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে থেকে প্রথম সাত জনের কবিতা প্রকাশ করা হল। বিশিষ্ট কবি টিপু রহমানের হাত ধরে জাতীয় কবি পরিষদ (জাকপ) বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় কবি সংগঠন। এই সংগঠনটি শুরু থেকেই সাপ্তাহিক কবিতা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে চলেছে। যেখানে অনলাইন একটিভ হাজার হাজার কবি নিয়মিত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করেন।
১।
অচেনা কবি
ফাহমিদা লুমা
————————-
আমার কবিতাগুলো ছিলো অনেকদিন গোপন কুঠুরিতে বন্দি
তুমি হাতে তুলে দিলে স্বপ্নের তুলি ,
একশো একটি গোলাপ নিয়ে
কবিতার সাথে হলো সন্ধি ।
শুকতারা আর সন্ধ্যাতারা ছিলো
আমার তারা চেনার পরিধি ,
তুমি হাতে ধরে চেনালে তারাদের রাজ্য
আমি একে একে চিনলাম লুব্ধক,রোহিণী,অরুন্ধতী।
ফুলেদের রাজ্য চিনিয়েও করলে ঋণী
কৃষ্ণচূড়ার লাল , অপরাজিতার নীল,
জারুল ফুলের বেগুনি আভায় নিজেকে রাঙিয়ে
প্রবল উচ্ছ্বাসে; অনুরাগে হলাম লাল,নীল,বেগুনি।
মেঘের দেশে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো প্রবল
তুমিই জানালে “কত মেঘে জল হয়েছে”
গল্পের আড়ালে লুকিয়ে থাকা গোপন অশ্রুজল;
বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়া “জল লুকনোর ছল” ।
অঝোর বর্ষন, পূর্ণিমার ঘোর লাগা আলো
প্রজাপতির পাখার রঙ, দোলনচাঁপার শুভ্রতায় দেখালে কবিতার পৃথিবী,
পৃথিবীর সমস্ত কদর্যতাকে ঠেলে দিয়ে পিছে
নতুন উপলব্ধিতে; চেনা পৃথিবীতে আমি হয়ে উঠলাম এক অচেনা কবি।
২।
আমি নদী হতে চাই
এস, এম, তোফিক এলাহী
সদা বহমান নদীর কাছে গেলে দেখি
সে নিঃসঙ্গ তবুও উদার নিষ্পাপ
ওর কোন চাওয়া নেই
ওর কোন অপ্রাপ্তি নেই
আমি তখন জল হতে চাই।
.
আমি একবার আকাশের দিকে তাকাই
আবার কালজয়ী খরস্রোতা নদীর দিকে
বাতাসে দোলায়িত যুবতীর কালো চুলের মতো
ঢেউ দেখি ওর বুকে
সোনালী সূর্য আর রূপালী চাঁদ বোধহয় ওর জন্যই তৈরী
দিন-রাত দুজনে উদার বুকে আলো ছড়ায়
তখন নদী হতে চাই।
.
মায়াবতী মেঘেরা জল ঢালে সন্ধ্যাকাশের ধ্রুবতাঁরার আঁচলে
বৃষ্টির অভিযোজন পূর্ণতা আনে জলে
আরণ্যক নদী বিকশিত হয়
জোয়ার আসে বাউরি বাতাসের দোলায় বাসন্তি কুসুমির মতো
দুকূল ভাসিয়ে দেয় মাধবী মালতি পল্লবে
আমি জোয়ার হতে চাই।
.
স্রোতস্বিনীর ধূপছায়া তরঙ্গে কোজাগরি পূর্ণিমার
বর্ণিল তরঙ্গে ছুঁয়ে যায় হৃদয়
হিরকের মত চকচক করা চাঁদের মিতালী আলো
এঁকে দেয় নদীর বুকে এক শুভাশিস প্রভা
চেয়ে থাকি পূর্ণেন্দু রাতের শোভায়
আমি তখন শান্ত নদী হতে চাই।
৩।
কবির জন্য কবিতার আকাশ
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ
লোনাজলের ডানপিটে স্রোত উল্টোসাঁতারের তানপুরা বাজায়
কসরত করে করে হলো পার সুন্দর বিকেলের অনিন্দ্য পৃষ্ঠার বিবর্ণা আহাজারি
গোলাপের স্পর্শ থেকে ছিটকে যখন পড়ি তখনো আকাশ আমাকে ডাকে আকাশের মেঘ আমাকে জল দেয় বুকের ভেতর।
কামিনী,গন্ধরাজ,বেলি মল্লিকাদের বিলিয়ে দেয়া অনুভবটুকু কুড়িয়ে নিয়ে হেঁটে যাই স্ফটিকস্বচ্ছ লাবণিক প্রেমের সরু সরু আলপথে
শিহরিত ঘাসগুলো
আর যত প্রসন্ন বর্ণিল প্রজাপতিরা লিখে রাখে কবির জন্য কিছু প্রদায়ক সংলাপ
কবি এক কুড়ায় আনতমুখে
ধরে রাখে তারে
বুকের বামপাশের চেনা চেনা অলিগলিতে বেজে ওঠা সুরের আলাপনে
রেখেছি বলে এখনো
আকাশের প্রণয়কাতর আবীরে রাঙ্গানো মুখটাকে প্রতিসন্ধ্যায় চুমু খাই।
৪।
নক্ষত্রের পিঠে বিরল উপন্যাস
রোশনী ইয়াসমীন
সুখ – দুঃখ কোনটাই লিখিনা-
সুখ সামনে এলেই দুভাগে ভাগ হয়
নিত্যনৈমিত্তিক আর সম্পর্কের দায়বদ্ধতায়।
দুটোর কোনটা আসল ঠাওর করতে পারি না!
যেটুকু আছে, খামচে ধরি –
ঘর বাড়ি কার্নিশে জমে থাকা
অনাত্মীয় অ-সুখদের সারাই !
এখন আর সমাজের পাড়ায় বেড়াতে যাইনা-
আড়াল, বাঁধাধরা ইতিহাসের চরিত্র
নিয়মমতো আসে, বিভিন্ন শর্ত বিলিয়ে
নিঃশব্দে শর্তের পাশে “না” রেখে যাই।
হাজার বছর ধরে একই রাত-
শুধু ওই রাতে বাঁচা, মরা, মরতে চাওয়াগুলো আলাদা
চুপ করে জেগে থাকে নির্বোধ হতাশা, দুঃখ, শোক ওরাও একঘেয়ে!
অনেকটা ভয়ের মতো-
হারানোর ভয়! পাওয়ার ভয়! পতনের ভয়!
অন্ধকারে মুক্ত হই –
ভেতরে রয়ে যাওয়া তমসায় লিখি,
নক্ষত্রের জ্যামিতিক পিঠে
বিরল সেই উপন্যাস!
৫।
দুঃস্বপ্নের বিনিদ্র চোখে
সোহেল মাহমুদ
যেদিন এসেছিলাম এইখানে পুরনো মৃত্তিকায়,
সেই আমার অব্যাগত ভোরের শিশির ভেজা পায়ে
এখনো চলেছি হেঁটে,
কোন এক অশরীরী গন্তব্যের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রয়োজনে।
যে জীবন ছিল দল কলসের পাতার মতো সজীব,
ধান শালিকের চোখের মতো উচাটন।
সময়ের ব্যবধানে সেই সব স্মৃতি, বিষন্নতার বিস্মৃতি হয়ে
বাসি গন্ধরাজের পাপড়ির মতো পড়ে আছে
বিধ্বস্ত বুকের উঠোনে !
যে দিন চলে গেছে পুরনো প্রণয়ের মতো,
কোন এক ষোড়শীর মতো।
আজ চল্লিশটি বসন্ত পেরিয়ে যাবার পর,
প্রিয় তিতাসের নিঃসঙ্গ সৈকতে বসে ভাবি,
যে সময় চলে গেছে যাবারইতো ছিলো।
আমার কৈশোর এখনো কি আছে ?
যে চিঠি হয়নি লিখা, এখনো কি লিখি ?
তবে কেনো দুঃসহ স্মৃতি কাতরতা ?
একোন অনির্বচনীয় প্রয়োজনে
নিঃসীম প্রতীক্ষা আমার ?
হৃদপিন্ডের সমুদয় প্রকোষ্ঠে কীসের এতো তোলপাড় ?
কিছু প্রশ্নের উত্তর অজানাই থেকে যায় !
কিছু স্বপ্ন নীড় খুঁজে বেড়ায় আজীবন !
এই সব জানি !
তবুও যে জীবন নিজের অজান্তেই
নিরুদ্দেশ হয় রূপালী জোছোনায়।
সেই প্রিয় জীবনের পায়ে হেঁটে
অবগাহন করে এক আয়ুষ্কাল, দুঃস্বপ্নের বিনিদ্র চোখে
এখনো বিচরণ করি অনন্ত অমানিশার বুকে !
৬।
আলো আঁধারে
আরজেনা শিরীন
জীবন সেতো এক বিস্ময় সময়ের কালগ্রাসী স্রোত,
কখনো জ্বলে কখনও নিভে, নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে যায়।
যে প্রেম ছড়িয়ে বসত করে হৃদয় জুড়ে,
পুরো আকাশ উষ্ণ হঠাৎ নক্ষত্রের পতন ঊর্মির নিঃশ্বাসে। আঁধারের রাত্রি শোকের নিঃশব্দ গহব্বরে মৌন অভিযান নষ্ট নাশপাতির ইন্দ্রিয় যেন গন্ধ।
চৈত্রে পোড়া দুপুরে পাতা ঝরার মড়মড় শব্দ প্রতি নিঃশ্বাসে,দুর্দান্ত প্রাণের ছুটে চলার সুখের তরঙ্গে দুঃখের বিচ্ছুরণ ছটা।
স্মৃতির ক্যানভাসে সব বীভৎস ক্ষত- বিক্ষত,
বিচিত্র রংয়ের সমাহারে সুখের সকল আয়োজন নিষিদ্ধ হয়ে উঠে চূর্ণ – বিচূর্ণ তপ্ত ভূমির ন্যায়।
সবুজ কচিপাতা ও কঠিন পাথর কেঁদে চলেছে প্রতিনিয়ত।
স্মৃতিপটে প্রাণহীন স্বপ্নগুলো প্রাণের বীণ বাঁজায়,
কখনও বিসর্জনের মানচিত্র এঁকে যায়।
বুনো ডাহুকের সরগমে অজানা ভয়ের বিকাশ ঘটে।
কষ্টের বিলাসিতা রাত্রির নিস্তব্ধতায় স্পষ্ট হয়।
রোমন্থনের সৌন্দর্য্যময় হাসি লাল,নীল কষ্টের প্রহর শেষে রহস্যময় কান্নায় বিচরণ করে।
হৃদয়ে লালিত স্বপ্নগুলো অভিমান জমে দুঃস্বপ্নের নদীতে পরিণত হয়।
প্রেতাত্মারা ছেয়ে থাকে বিষাক্ত বলয়ে।
আধো আলো ছায়ায় সুপ্ত নির্জনতায় নিজেকে খুঁজে ফিরে।
ঘড়ির চলমান আবর্তে বিদীর্ণ হয় জীবনের সব রঙ।
পিছনে ঝটিকা সম্মুখে সন্দিহান বিবর্ণ চোখে অসম্মতি,
আলো আঁধারের সন্ধিক্ষণে বয়ে চলে দীর্ঘশ্বাস,দুর্দিনের ক্ষয়িষ্ণু দিনেরা কাঁদে অনর্থক প্রসব ব্যথায়।
কী উচ্ছ্বল! কী চঞ্চল!
প্রাণের স্পন্দন আজ জ্বলন্ত ধূপ।
৭।
লুকানো বিবেক
অরন্য হাসান দেলোয়ার
লুকিয়ে থাকে যে
লুকিয়ে থাকে যে মানুষের অন্তরে,পর্দার আড়ালে
বৃষ্টির জলে ভিজে যায়-চোখের জলে ভাসে না
সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ এসে আঘাত করে যায়
মৃত্যুঘুম তার ভাঙ্গে না।
বসবাস করে যে মানুষের অন্দরমহলে
খোলা চোখে দেখা যায় না
অশ্রুর লোনা জল এখন তাকে ছুঁতে পারে না।
রক্তের স্রোতে ভেসে যায় প্রতিদিন
বাঁচার আকুতি ভেসে আসে বাতাসে
তবুও নিশ্চুপ স্থির শান্ত নির্ভার সে হাসে।
ঝলসে প্রিয়জন পুড়ছে বসন্ত,দশ দিগন্ত
অন্যায়ের শিকলে বাঁধা পড়েছে কবিতার ছন্দ
প্রতিবাদী চেহারা হারিয়ে-
প্রেমকুঞ্জে শরাবে মশগুল কবি এবং কবিতা।
লুকিয়ে থাকে যে-
লুকিয়ে থাকে যে,মানুষের বুকের গহীনে
শক্ত হাড়ের ঘরে বিবেক নামক সেই অচিন প্রাণী।