একবিংশ শতাব্দীর ইসলামী সংগীত জগতের কিংবদন্তী, যুগের চ্যালেন্জ মোকাবেলায় যিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য তিনি হলেন ইসলামী সংগীত সম্রাট মাওলানা আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ।তিনি ছিলেন মানবতাবাদী, সাম্যবাদী ও বিপ্লবী সাংস্কৃতিক কর্মী।তাঁর চিন্তার সাথে দর্শনিক চিন্তা বেশ সাদৃশ্য পাওয়া যায়।
মানবতাবাদী হিসেবে আইনুদ্দীনরর দর্শন চিন্তাঃ
আইনুদ্দীন আল আজাদ এর সংগীত চর্চায় মানবতাবাদী চেতনার রূপ ফুটে উঠেছে।তিনি অসহায় মানুষের ব্যাথায় ব্যথিত ছিলেন।তাঁর দর্শন চিন্তা ইসলামী জাগরণ সৃষ্টি করে।তাঁর কণ্ঠে মানবতার গান ও সাম্যের গান শোভা পেত।যেনম
ব্যাথা বুকে আমি গান গাই কষ্ট ছুঁইয়ে পড়ে তাই
কষ্টের নদী যে এতই গভীর কূল কিনারা তার নাই
গুমরে কাঁদে কত অসহায় মা বোন
জানতে চাইনি কেউ কি তার কারণ
যন্ত্রণার কষাঘাতে ওদের যে আজ কেউ নাই।
বিপ্লবী হিসেবে আইনুদ্দীনঃ
আইনুদ্দীন আল আজাদ ছিলেন একজন নিন্মমধ্যবিত্ত পরিববারের সন্তান। স্বাভাবিকভাবেই নির্যাতিত,নিষ্পেষিত, নিপীড়িত, দরিদ্র জনগনের আশা – আকাঙ্কা তাঁর গানে বাণীরূপ পেল।
যেমন, স্বাধীনতা চাইনি আমি এই স্বাধীনতা স্বাধীনতা পাইনি আমি সেই স্বাধীনতা যাহা চাইনি তাহা পেয়েছি আমি চেয়েছি তাহা পাইনি তাই তো আমি বিদ্রোহী আজ কথা গুলো বেআইনী।
আল্লাহর ঘর রক্ষা করতে জীবন দিতে হলো
তাহলে দেশে ইসলাম আছে কি করে তোমরা বলো??
দেশপ্রেমঃ আইনুদ্দীন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক ছিলেন। তাই তাঁর কণ্ঠে –
রক্তে কেনা বাংলা আমার লাখ শহিদীদের দান
তবুও কেন বন্ধু তোমার বিদেশের প্রতি টান
যে জাতি তার জীবন দিয়ে কিনে নেয় স্বাধীনতা
সে জাতি কেন অন্যের তরে নত করে তার মাথা।
প্রতিবাদী আইনুদ্দীনঃ
আইনুদ্দীনের দর্শনে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর একটি উল্লেখযোগ্য দিক।তিনি তাঁর দর্শনে সকল অন্যায়, অনাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন।তিনি এই সব অন্যায়, অবিচার হতে সাধারণ মানুষকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন।তাই তো তিনি গাইলেন
কি হবে বেঁচে থেকে অযাথা বিদ্যা শিখে
যদি না গড়তে পারি শোষণ বিহীন সমাজটাকে
কি হবে লেখালেখির কলমবাজির ঐ মহড়া
সমাজের আসল চিত্র যদি না যায় তুলে ধরা
কি বা জবাব দিবে কিভাবে মুখে দেখাবে
আমাদের আগামির সেই প্রজন্মকে।
কি হবে আলেম হয়ে ইমাম সেজে সমাজেতে
যদি ঐ খোদার কোরআন পড়ে থাকে নর্দমাতে
যদি ঐ ঘুষের বলে কলমটা উল্টা চলে
কিভাবে রূখবে তুমি দুর্নীতিকে?
পরোপকারী মানসিকতাঃ
আইনুদ্দীন আল আজাদ ছিলেন একজন পরোপকারী ব্যক্তি।তিনি ব্যবসায়িক মানসিকতা নিয়ে সাহিত্যে ও সাংস্কৃতিক চর্চা করেনি।তিনি চেয়েছিলেন পশ্চিমা অপসংস্কৃতির করালগ্রাস থেকে দেশের তরুণ, কিশোর ও যুব সমাজ কে বাঁচাতে।অপসংস্কৃতির প্রতিরোধে সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশই তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল। তাই তো পশ্চিমা সংস্কৃতির নিয়ে তার গান-
সকাল বেলা পান্থা খেয়ে বৈশাখের ঐদিনে
বিকেলে আবার উঠছে মেতে ইংলিশ হিন্দি গানে
নিজেদের সব ভুলে আজ সেজেছে হনুমান।
উদার মানসিকতাঃ
আইনুদ্দীনের অন্যতম দর্শন হল উদার নীতি।তিনি সবার ক্ষেত্রে উদারতা দেখাতেন।তাই তো তাঁর কণ্ঠে শোভা পায়-
আকাশের মত মোর হৃদয়টা কর দাও
জমিনের মত তুমি ধর্য্য দিয়ে দাও
সয়ে যেতে পারি যেন সব দুঃখ এমন
হৃদয় তুমি আমাকে।
জুলুমে জুলুমে হৃদয় আমার পুড়েছে অন্তর হয়েছে হাহাকার
জ্বালা সইবার সম্মুখে যাওয়ার সাহস তুমি আমাকে দাও।
পরকালের ভাবনা ও বন্ধু প্রেমঃ
পদ্মা মেঘনা যমুনার তীরে কত ঢেউ চলে যায় আসে না তো ফিরে
তেমনি আমিও হারিয়ে যাব আসবনা কভূ ফিরে
ঐ চাঁদ ঐ তারা ঐ অাসমান সবই রবে আগের মত
থাকবনা আমি শুধু ক্ষণিকের মিছে এই জীবন
তাই কান্নারা বিরহের ঢেউ তুলে যায় আমার এই হৃদয় জুড়ে।
বন্ধু — ভুলে যেয়োনা কখনও
যেখানেই থাক যেভাবেই থাক মনে রেখ আমিও আছি তখনও
একই সাথে লড়েছি খেলারই মাঠে আড্ডা চলেছ কত
একই সাথে মিছিলে সংগ্রামে রাজপথে বাধা সয়েছি শত শত
আজ কত দূরে কেবা কোন শহরে
আমি আছি, আমি আছি কাছে টেনে নাও।
প্রভূর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশঃ
আইনুদ্দীন আল আজাদ এর সাংস্তৃতিক অঙ্গনে পদাচারণা নিছক কোন পার্থিব স্বার্থ হাসিলের জন্য নয়।তাই তো তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে-
গান গেয়ে গেয়ে কুড়াতে চাইনি যশখ্যাতি
জানাতে চেয়েছি কৃতজ্ঞতা তোমার প্রতি
তুমি যে আমার সর্বদাতা সুরের পথে চলার গতি
এ কলম যেন ও গো শুধু লিখে যায় তোমরই সব গুন গান।
সর্বশেষ বলতে হয় আইনু্দ্দীন আল আজাদ ছিলেন কাজী নজরুল পরবর্তী একজন বিদ্রোহী কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও সংগীত শিল্পী।যার দর্শন চিন্তায় স্থান পেয়েছে,দেশ প্রেম,স্বাধীনতা,মানবতা,সাম্যবাদ,প্রভূপ্রেম,।একজন দার্শনিকের যে চিন্তা চেতনা থাকে তার সবটাই ছিল আইনুদ্দীন আল আজাদের।এই অমর দার্শনিক ২০১০ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত হন।তাঁর প্রতিটি গান বাংলা সাহিত্যের অমূল্য রত্নতুল্য।
লেখকঃ নুর আহমদ সিদ্দিকীLike