কালকে একটা মজার ঘটনা দেখেছি! আমাদের এলাকায় এক পাগল লোক ছিল, একেবারেই বদ্ধ উন্মাদ । লোকটা মারা গেছে প্রায় বছর তিনেক হয়ে এল। কাল দেখলাম লোকটার নামে ব্যানার টানানো হয়েছে তার নামে ওরশ আর মিলাদ মাহফিল হবে।আমি মেয়ের বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম যারা আয়োজন করছে তারা তাদের বাবা মায়ের খবর ঠিকঠাক মত নেয় তো?আর গরীব আত্নীয়স্বজন তাদের ? এইযুগেও কি অবাক করার মতো মানবতা! নাকি অন্যকিছু? একজন পাগল লোক যে মারা গেছে তিন বছর আগে হঠাৎ তাকে আধ্যাতিক প্রমান করার কি আপ্রান চেষ্টা! বিষয়টা মোটেও মজার নয় বিষয়টা হতাশার, তবে যা চলে এসেছে এবং চলতে থাকবে তাতে আমাদের মতো স্বল্পজ্ঞানের মানুষের অভ্যস্ত হয়ে যাওয়াই ভালো !
ছোট বোনের কাছে আরেকটা তথ্য পেলাম একজনের বাড়ির মেজে কিছুটা উঁচু হয়ে গেছে সেখানে লাল কাপড় টানিয়ে দেওয়া হয়েছে জায়াগাটাতে অলৌকিক শক্তি ভর করেছে সেটা রটানো হচ্ছে!
বিকারগ্রস্ত এক উন্মাদ হঠাৎ দাবি করলো সে সন্ন্যাসী হয়ে যাবে, সে তার স্ত্রী কন্যাকে বাড়ি থেকে বের করে দিল এবং বাড়ির জায়াগা দলিল করে দিল কোন এক ফকিরের নামে, রোজ সন্ধ্যায় সেখানে এখন মদ গাঁজার আসর বসে! সবচেয়ে চমৎকার বিষয় হচ্ছে তার এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানানোর মানুষের অভাব হলো না এবং অনেক মানুষ সেচ্ছায় তার মুরিদ বনে গেল! অথচ বের করে দেওয়া সেই অসহায় মা মেয়ের খবর নেওয়ার কোন লোক নাই!
রোগ শরীরের হয় মনের কোন রোগ নাই, আর যদি আচরণের কোন অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে তাহলে সেটা ভূতে ধরা জ্বীনে আছড় করা এর বাইরে অন্যকিছু ভাবার সুযোগ নাই! ফকির ডাক, ওঝা ডাক চোখের সামনে প্রিয় মানুষকে ঝাড়ু পেটা করবে, তেল মরিচ গরম করে নাকে ঢেলে দিবে, হাত মুচড়িয়ে দিবে, আঙ্গুলে সজোরে চিমটি কাটবে, এইপাতা ঐ পাতায় ভূত ভয় পায় বলে তাকে সেটা দিয়ে মারতে থাকবে! আপনি যদি সাধারণ মানুষ হন মানুষটার যন্ত্রনা আপনাকে কষ্ট দিবে তবে চিন্তা নেই আপনার জন্য সান্ত্বনা আছে কষ্ট আসলে জ্বীন পাচ্ছে মানুষটা না!
আমার পাশের বাড়ির একমেয়ে ছিল সে একদিন বলছিলো তার মেয়েটা রক্তশূন্যতায় ভুগছে। আমি বললাম তাকে ঠিকমত খাওয়াও না? সে বলল, আমার সাথে তো উপরি আছে তাই আম্মায় বুকের দুধ খাওয়াইতে দেয়না! আমি জিজ্ঞেস করলাম ডাক্তার কাছে নিয়ে গিয়েছিলে? সে বলল,ডাক্তার বকা দিছে বলছে বুকের দুধ যদি বাচ্চাকে না খাওয়াই তার কাছে যেন আর নিয়ে না আসি ।আমি বললাম,জ্বীন তোমার বাচ্চাকে না মেরে ফেললেও না খাইয়ে বাচ্চাটাকে যে মেরে ফেলবে এটা নিশ্চিত!
দুই তিন বছর আগের ঘটনা গুজব ওঠলো কলেজ পড়ুয়া এক ছেলের উপর জ্বীন ভর করছে, ভালো জ্বীন! সে আবার মানুষের মনের আশা পূরন করছে চাল, ডাল, মুরগী, খাসির বিনিময়ে! রোজ মঙ্গলবার বিকেলবেলা এলাকার মহিলারা, পুরুষেরা লাইন ধরে ঐ বাড়িতে ছোটে আর এসে নানান অলৌকিক ঘটনার বর্ননা দিতে থাকে! এর মধ্যে থেকে যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়,আপনি কি এসব নিজে চোখে দেখেছেন? তাহলে আর উত্তরের কোন আগামাথা খুঁজে পাওয়া যায় না!
এক বুদ্ধি প্রতিবন্ধি বাচ্চার মা আফসোস করছিলো তার ছেলেকে নিয়ে, এমন কোন ফকির কবিরাজ সে বাদ রাখে নাই তার ছেলেরে সুস্থ করার জন্য! আমার মেয়ের বাবা তাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, ডাক্তার কাছে নিয়ে গিয়েছিলে? সে বিরক্ত হয়ে বলেছিল,ডাক্তার কি করবে? আসলেই ডাক্তার কি করবে! তাইতো নিউমোনিয়া হওয়া বাচ্চাকে নিম পাতার প্রলেপ মেখে ওঠানে ফেলে রাখা হয় তাকে “ছোট জ্বীনে ধরেছে”পেটের অসুখে লেবু পড়া জন্ডিস হইলে মিছ্রি পড়া এই তাবিজ সেই তাবিজ,সুস্থ হওয়ার এতো উপায় থাকতে কি দরকার ডাক্তারের কাছে যাওয়ার!
এই ঘটনাগুলো শুনলে যে কারো মনে হতে পারে প্রত্যন্ত কোন গ্রামের কথা বলছি, যেখানে আধুনিকতা পোছায়নি বাড়েনি শিক্ষার হার আর মানুষ হয়নি সচেতন! বিষয়টা মোটেও এমন নয়, মফস্বল, এমনকি শহরের সব আধুনিকতা ভোগ করছে জায়গায়ও অহরহ ঘটছে এসব ঘটনা! তাহলে প্রত্যন্ত গ্রামে কি ঘটছে সেসব বোঝার জন্য গবেষক হওয়ার দরকার নাই।
উপরের মৃত পাগলের ঘটনাটা তারা যেদিকে নিতে চাচ্ছে সবকিছু যদি ঠিকঠাক মতো হয় তাহলে দুই তিন বছরের মধ্যে মাজার ওরশ বিশেষ দিনে সবার মনের আশা পূরন হবে, এবং বিভিন্ন অলৌকিক ক্ষমতার আগামাথা ছাড়া খবর ঘটানো হবে রটানো হবে আর অস্তিত্ব সংকটে ভুগতে থাকা কিছু মানুষ আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে যাবে এবং নিজের একটা সামাজিক জায়গা তৈরী করে নিয়ে এলাকার মোড়ল বনে যাবে! এর চেয়ে চমৎকার আর সহজ ব্যাবসা আর কিছু হতেই পারেনা। তবে অবাক করার মতো ঘটনা হচ্ছে এসবের পিছনে যদি ৫ জন লোক থাকে এর মধ্যে অন্তত তিনজন আছে শিক্ষিত যে অক্ষর জ্ঞানহীন দুই জনের চেয়েও বেশী আত্নবিশ্বাসী হয়ে কাজ করবে কারন সে জানে এইখানে লাভ ছাড়া লোকসান নাই! চমৎকার ধান্দা!
মেজে ফুলে ওঠার বিষয়টা যে সামান্য কোন ত্রুটি থেকে ঘটেছে এসব বোঝার জন্য স্থাপত্য বিদ্যা পড়ে আসার দরকার নেই নিশ্চয়ই!
সেই কলেজপড়ুয়া ছেলের জ্বীনের খাতির যত্নের জন্য ৩০০ বড় পাতিলে খাবার রান্না করা হয়েছিল এবং এখানে প্রতিযোগিতামূলকভাবে অংশগ্রহন করেছিল এলাকার নেতারা, বিত্তবানেরা এবং মনে মনে যারা সমাজসেবক তকমা লাগাতে চায় তারা! অথচ ভালো কাজগুলোতে যদি এমন প্রতিযোগিতা হতো ! বিনা চিকিৎসায় কেউ মারা যেতো না অন্তত সমাজে আকাশ পাতাল শ্রেণী বৈষম্য থাকতো না! সেই জ্বীনকে মানে জ্বীনের মালিককে নিয়ে শেষ পর্যন্ত কোর্টে মামলা মোকদ্দমা পর্যন্ত হয়েছে একজনের কাছ থেকে সে টাকা নিয়েছিল এর দুই গুন তিন গুন গুপ্তধন পাইয়ে দিবে বলে,শেষ পর্যন্ত কি ঘটেছিল সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না!
এখন এমন ফ্যামিলি খুজে পাওয়া মুশকিল যেখানে অন্তত কেউ পড়াশোনা করেনি! তারপরও কেন এসব কমছেনা? অনেক শিক্ষিত চেলেমেয়েরাও এসব ধারণ করছে পরিবারের কোন ঐতিহ্যের মতো করে! আবার কখনো এসব ঠিক হচ্ছেনা বুঝতে পেরেও চুপ করে যাচ্ছে তাদের এতোদিনের লালিত বিশ্বাসকে ভুল বলে উগ্র, উদ্যত, বেয়াদব খেতাব চায়না বলে!
জীবিত লোক যখন নিজের নামে মাজার করে আর সেই মাজারের উদ্বোধন করে মেয়রের মতো সম্মানিত কেউ তাহলে মাজার ব্যাসায়,নিশ্চয়ই সম্মানের! চোখের সামনে এই ব্যাবসা যখন লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিনত হচ্ছে, লাখ টাকা নয় কোটি টাকারও ব্যাবসা করছে তখন শিক্ষিত , জ্ঞানহীন কিংবা বিকারগস্ত যেকেউই হুজুগে সুযোগ নিতে চাইবে সেটাইতো স্বাভাবিক! আর আমাদের মতো সাধারণেরা আমদের জন্যও ব্যাবস্হা আছে, ওরশ হয়, নাচগান হয়, সপ্তাহে একদিন বিশেষ দিন হিসেবে ফ্রি খাবারের ব্যাবস্হা হয়, মেলা হয় প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করা যায়৷ এতো এতো বিনোদন আর কি লাগে?
আরেকটা মজার বিষয় হচ্ছে কিছু হলেই আমরা যে পীর ফকিরের কাছে যাই তারা আবার তাদের কিছু হলে সিংগাপুর চলে যায় চিকিৎসার জন্য ! কি অদ্ভুত নিজেদের বিদ্যার উপরে তাদের নিজেদেরই ভরসা নাই!
বইয়ের জ্ঞান মানুষকে ভাবার সুযোগ করে দেয় আর বাস্তব জ্ঞান দেয় অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি। আমার সেই উপলব্ধির কিছুটা তুলে ধরা সম্ভব এই বিষয়ে যতটা দেখার সুযোগ হয়েছে ততটা যদি তুলে ধরি তাহলে সারাদিন লেখতে হবে। আরও ১০০ বছর পরেও যদি সৈয়দ অলি উল্লাহ লাল সালু লেখতো তাহলেও আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটের সাথে মিলে যেত নিশ্চিত! তখন হয়ত আরও আধুনিক আরও বড় পরিসরে হবে এসব!
এই লেখাটা যখন আমি লেখছি তখনও আমার মেসেঞ্জারে একটা মেসেজ এসেছে আমি যদি এটাকে ১০০ জনের কাছে ফরোয়ার্ড করি তাহলে ৫ দিনের মধ্যে আমার মনের আশা পূরন হবে! একজন ৫০ জনকে পাঠাইছে সে তার ব্যাবসায়ে ৪ লাখ টাকা লাভ করছে! কি লোভনীয় বিষয় ! আমি চিন্তা করতেছি ৫০ জনেরে না আমি ১০০ জনকে পাঠিয়ে দিব কিন্ত বিষয় হচ্ছে গিয়ে এতো টাকা যে কোথায় থেকে আসবে আর আমি এতো টাকা যে কিভাবে খরচ করবো সেই টেনশনে পড়ে গেছি। ৫০ জনকে পাঠিয়ে সে ব্যাবসায় ৪ লাখ টাকা লাভ করছে এখন কথা হচ্ছে বর ছোট খাটো একটা সরকারি চাকরি করছে তার মাধ্যমে এতো টাকা আসা সম্ভব নয়! আমার জীবনে আমি লটারিও ধরি নাই যে সেখানে কিছু অলৌকিক কান্ড ঘটে যাবে, আবার আমি হচ্ছি বেকার গৃহীনী টাকাটা যে কই থেকে আসবে? চাল ডালের ডিব্বা খুজে দেখতে হবে যেইভাবে জ্বীন ভূতের প্রশংসা করলাম তারা খুশী হইয়াও দিয়ে যেতে পারে!!!